চার বছরের একটি বাচ্চা দৌঁড়ে তার মায়ের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। বাচ্চাটির চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। বাচ্চাটি যে ভয় পেয়েছে তা তার মা বুঝতে পেরে তাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর বিছানায় গিয়ে বসিয়ে বাচ্চাটিকে স্বাভাবিক করলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো -
- তোমার কি হয়েছে সোনা? কেন ভয় পেয়েছো?
- মা! মা! জানো কি হয়েছে?
- জানি না তো সোনা! তুমি বলো মাকে।
- একটা কুকুর না আজকে আমাকে তাড়া করেছিলো।
- কি বলছো? তারপর কি হলো সোনা? সে কি তোমার কোনো ক্ষতি করেছিলো?
- না মা শোনো কি হয়েছে!
- হ্যাঁ সোনা বলো।
- কুকুরটি আমার পায়ে কামড় দিয়েছিলো। ও যখন আমার পায়ে কামড় দিয়েছিলো তখন আমি ভেবেছিলাম পা থেকে বোধহয় রক্ত পরছে এখন। ব্যাথা পাওয়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলাম।
- তারপর কি হলো সোনা?
বাচ্চাটির মা অস্থির হয়ে বাচ্চাটির পা চেক করছে আর কথা বলছে। বাচ্চাটি তার মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বললো -
- কয়েক মূহুর্ত পর যখন কোনো ব্যাথা অনুভূত হলো না বরং কুকুরটার চিৎকারের শব্দ পাচ্ছিলাম তখন চোখ খুলে দেখি আমি একদম ঠিক আছি। বরং কুকুরটার মুখ গলে গলে পরছে। সে কি ভয়ংকর দৃশ্য জানো? আর আশ্চর্যের বিষয় জানো মা? আমি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটা খালি জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। আশেপাশে কোনো মানুষ ছিলো না। তাহলে কুকুরটার কিভাবে কি হলো বলো তো? আমার না খুব ভয় করছে মা!
বাচ্চাটির মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে আর তাকে ভয় পেতে দেখে তার মা আবার তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন -
- সোনা আমার। আমি যা বলছি তা মন দিয়ে শুনো কেমন?
মায়ের কথায় বাচ্চাটি মাথা নাড়ালো। তা দেখে তার মা মৃদু হেসে বাচ্চাটির মাথায় চুমু খেয়ে বললেন -
- শোনো সোনা! তোমার মধ্যে কিছু অদ্ভুত শক্তি আছে। যা অলৌকিক শক্তি। আর সে শক্তি গুলো তোমার অজান্তে তোমাকে নিরাপদে রাখছে। যখনই কেউ তোমার ক্ষতি করতে চায় বা চাইবে তখনই এই শক্তি গুলো তোমাকে বাঁচিয়ে তোমার ক্ষতি করতে আসা সকলকিছুকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিবে। তাই বিপদে পরলে কখনো ভয় পাবে না ঠিক আছে শোনা?
মায়ের কথায় বাচ্চাটি বুঝদারের মতো মাথা নাড়ালো। তারপর বললো -
- আচ্ছা মা আমার মধ্যেই কেন এসব শক্তি আছে? আমি কেন অন্য বাচ্চাদের থেকে আলাদা? আমার বয়সী বাচ্চারা ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না আর আমি সুন্দর করে কথা বলা ছাড়াও আরো অনেক কিছু করতে পারি।
- কারন বিধাতা তোমার ভাগ্যে এসব লিখেছে সোনা। এসব সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারবে বড় হলে। আপাতত এইটুকুই জানো যে তুমি কখনোই একা নও। তোমার এসব শক্তি সবসময় তোমার রক্ষা করবে তোমার মধ্যে থেকে আর তোমার পাশে থেকে তোমার অদৃশ্য বন্ধুর মতোন।
বাচ্চাটি চুপ করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রত্যেকটা কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো। বাচ্চাটিকে চুপচাপ দেখে তার মা বাচ্চাটিকে বললো -
- চলো সোনা তোমাকে গোসল করিয়ে খায়িয়ে দেই। তারপর সুন্দর করে ভালো বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে পরবে ঠিক আছে?
- ঠিক আছে মা।
এরপর বাচ্চাটি তার মায়ের সাথে ঘরের বাইরে চলে গেলো। ঠিক তখনই সেখানে এক অদ্ভুত অবয়ব দৃশ্যমান হলো। অবয়বটি এতোক্ষন এখানেই ছিলো তবে অদৃশ্য। এতোক্ষন সব কথাই শুনেছে সে। পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে মলিন হাসলো অবয়বটি। তারপর সে একটি বেগুনি খাম বিছানার উপর রেখে আবার অদৃশ্য হয়ে গেলো। বাচ্চাটি ও তার মা বাইরে থেকে ভেতরে এলো। বাচ্চাটির মা বাচ্চাটির মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে বিছানার উপর বেগুনি খামটা দেখে অবাক হলেন। বাচ্চাটিকে মাথা নিজে মুছতে বলে তিনি খামটা হাতে নিয়ে খুললেন। খামের মধ্যে একটি চিঠি। বাচ্চাটির মা যখনই চিঠিটি পড়লেন তখনই প্রচন্ড ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলেন। বাচ্চাটি তার মাকে কাঁপতে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো -
- মা মা কি হয়েছে তোমার?
বাচ্চাটির মা বাচ্চটির কথার কোনো জবাব না দিয়ে বাচ্চাটিকে দ্রুত জামাকাপড় পরিয়ে প্রথমে ঘর থেকে আর তারপর বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। এখানে উনি আর থাকতে পারবেন না। এখানে থাকলে নিজের জীবনের সাথে তার স্বামীর একমাত্র স্মৃতি তার কলিজার টুকরোকে হারাবেন। তাই তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে থাকা রাস্তা দিয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন বাচ্চাটির মা। রাস্তায় বেরিয়ে বাচ্চাটির মায়ের মনে হচ্ছে কিছু অথবা কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। সে বারবার পিছনে তাকিয়ে তেমন সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তাই মনের মধ্যে অস্থিরতা নিয়েই পথ চলছে। তাকে কে অনুসরণ করছে তা খুঁজে বের করার জন্য আরেকবার পিছনে তাকালো সে। তেমন কাউকে না দেখতে পেয়ে হতাশ হয়ে যেই না সামনের দিকে তাকালো। ঠিক তখনই তাদের দিকে কিছু একটা ধেয়ে আসা অনুভব করতে পারলেন। থমকে গিয়ে কি ভেবে যেন উপরে থাকাতেই সমস্ত ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ হয়ে গেলো যেন তার। একটি বিশাল বড় পাথর পাহাড় ঘেঁষে গড়িয়ে তাদের উপর পরছে। বাচ্চাটির মা বুঝলেন তার মৃত্যু নিকটে। সে জানে তার বাচ্চাটিকে তার বাচ্চাটির সাথে থাকা শক্তিগুলো বাঁচাবে। কিন্তু সেও যদি তার বাচ্চার সাথে থাকে। তাহলে শক্তিগুলো দুজনকে বাঁচাতে গিয়ে ঠিকমতো কাজ করতে পারবে না। ভাগ হয়ে গেলে শক্তি কমে যায়। সে বুঝলো আজ তার মৃত্যু অবধারিত। তাই আর কোনো উপায় তার কাছে নেই। তবে তার বাচ্চাটিকে তাকে বাঁচাতেই হবে। তার বাচ্চাটিই বড় হয়ে তার পিতামাতার মৃত্যুর রহস্য খুঁজে বের করবে। তার স্বামী তাকে কিছু শক্তি দিয়েছিলো। যা সে জীবনে একবারই ব্যবহার করতে পারবে। তাও খুব প্রয়োজনে। সেই শক্তিবলে সে যা করতে চাইবে কিছু সময়ের জন্য তাই হবে। যা তিনি এতোদিন ব্যবহার করেননি। তবে আজ করতে হবে। আজ যদি তিনি বেঁচেও যায়। তাও এখান থেকে বেঁচে যেখানে যাবে সেখানেই তাকে মরতে হবে। তাই নিজের জীবন বাঁচাতে এই শক্তির অপপ্রয়োগ সে করলো না। তবে বাচ্চাটিকে বাঁচাতে বাচ্চাটির মা তার সেই স্বামীর দেওয়া শক্তিটি আজ ব্যবহার করলো। চোখ বন্ধ করে মনে মনে কিছু একটা বলে তাদের উপর পরতে থাকা পাথরটির দিকে শক্ত চোখে তাকালো সে। সাথেসাথেই পাথরটি স্থির হয়ে রইলো। তা দেখে মলিন হাসি দিয়ে সে তার বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বললো -
- সোনা আমার। মা কিছু কথা বলি মন দিয়ে শোনো কেমন?
বাচ্চাটি মাথা নাড়ালো। তা দেখে বাচ্চাটির মা মৃদু হেসে বাচ্চাটির মাথায় চুমু খেয়ে বললো -
- সোনা এখন থেকে তোমার পথ তোমার নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। কিভাবে করবে তা তোমার বুদ্ধিবলে জানবে। তবে তোমার পথে তোমাকে অনেকে সাহায্য করবে। তোমার পথে অনেক বিপদ, অনেক কাটা থাকবে। সেগুলোকে তোমার পথ থেকে মূল সমেত উপড়ে ফেলতে হবে সোনা। আবার তোমার এই পথেই অনেক বন্ধু পাবে তুমি। সেই বন্ধুদেরও তোমাকেই চিনতে হবে। মনে রাখবে বন্ধু বেশে কিন্তু বিপদও থাকতে পারে। আবার বিপদ বেশে বন্ধু। তোমাকে বুঝতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে আর চিনতে হবে কে তোমার বন্ধু আর কে তোমার বিপদ। নিজের মনের কথা ছাড়া আর কারো কথা তুমি শুনবে না। মনে থাকবে সোনা?
- জ্বী মা। আমার মনে থাকবে।
- কখনো কোনো কিছুর প্রতি অতিরিক্ত দূর্বল হবে না। বিচক্ষণতার সাথে সমস্ত অবস্থায় লড়াই করবে। ঠিক আছে?
- ঠিক আছে মা। কিন্তু তুমি কাঁদছো কেন?
- আমার যাওয়ার সময় যে হয়ে গেছে সোনা।
- তুমি কোথায় যাবে মা?
- তোমার বাবার কাছে যাবো সোনা। তিনি আমাকে ডাকছেন।
- সত্যি? আমিও যাবো মা। বাবাকে দেখবো। বাবার কোলে উঠবো মা।
বাচ্চাটির খুশি দেখে তার মা বাচ্চাটিকে আবার জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিলেন। তারপর বাচ্চাটির কপালে চুমু খেয়ে বললেন -
- সোনা তোমাকে সেখানে নেওয়া যাবে না। তোমাকে এখানে থাকতে হবে। তবে চিন্তা করো না। আমি আর তোমার বাবা সবসময় তোমাকে দেখবো। তোমার পাশে থাকবো।
তার শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। পাথরটি আবার পরতে শুরু করেছে। তাই সে দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে একটা শিশি বের করে তার থেকে কিছুটা তরল নিয়ে বাচ্চাটিকে খায়িয়ে দিলেন। বাচ্চাটি সাথেসাথেই ঘুমিয়ে গেলো। তা দেখে সে নিজের সমস্ত শক্তি জড়ো করে তা দিয়ে প্রচন্ড জোরে বাচ্চাটিকে ছুঁড়ে মারলেন। তার ছুঁড়ে মারার পরই পাথরটিও তার উপর পরে তাকে চাপা দিয়ে দিলো। মরণ যন্ত্রণায় আকাশ পাতাল এক করে চিৎকার করলো সে। যা প্রতিধ্বনি হয়ে তার কাছেই ফিরে আসলো। মারা যাওয়ার আগে সে নিভু নিভু চোখে দেখতে পেলেন তার ছুঁড়ে মারায় বাচ্চাটি অনেক দূরে গিয়ে শূন্যে পরলো। শূন্য থেকে বাচ্চাটি যখনই নিচে পরবে তখনই এক সাদা রঙের বলয় তার বাচ্চাটিকে নিজের ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর ভাসতে ভাসতে সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো বহুদূর। বাচ্চাটি ঘুমে থাকায় কিছুই টের পেলো না। বাচ্চাটিকে নিরাপদ দেখে তার মা মৃদু হাসলেন। তারপর আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে পাড়ি দিলেন না ফেরার দেশে।
(সমাপ্ত)
গল্পাংশ
অদ্ভুত_শক্তি
Sumaya_Akhi