বাংলা অনুগল্প: তোমাকে নিয়ে লেখিকা নূপুর ইসলাম

 অনুগল্প
তোমাকে নিয়ে
নূপুর ইসলাম 


সিহাব এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে  মিতুর দিকে তাকালো।  হলুদ শাড়ি, ফুলের গয়না, হাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে আহানের সাথে খুনসুটি করার চেষ্টা করছে । আর আহান থম মেরে বসে আছে। তাঁর নিজের যে মনের  অবস্থা, আহানেরও একই অবস্থা। সে হাসলো! সে ঠিক বুঝতে পাড়ছে  অচেনা  এক শিহরণ তাঁর মনে সুর তুলছে । কিন্তু  সে তো এটা  চায়না । কারণ এ চাওয়া সার্থপর। সে একটা দীর্যশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো!  আহানের সামনে গিয়ে বললো, " অনেক রাত হয়েছে আব্বু, এখন চলো আবার কাল এসো।  " 
আহান টলমলো চোখ নিয়ে উঠে এলো, সে তাঁর বাবার মতোই। মনে কথা সহজে মুখে আনতে পারে না।  অবশ্য  সে চায়ও না। এই মেয়েটা  অর্ধেক জীবন তাঁর  চোখের বিষ ছিলো। আর সারাজীবন  তাই থাক। 

মিতু ছিলো আমার চেয়ে  গুনে গুনে নয় বছর, সাত মাস, এগারো দিনের ছোট। এটা অবশ্য আমার না তাঁরই মুখের বাক্য। সে যে শুধু আমার বয়সে ছোট তা না হাইটেও ছোট। আমি শহরে বেড়ে ওঠা লম্বা চওয়া নায়কের মত সুদর্শন যুবক আর সে  ছোট খাটো পুতুলের মতো সাধরণ একটা গ্রামের মেয়ে । সে ছিলো আমার ফুপির ননদের মেয়ে। এতো এতো মেয়ের মাঝে এই মেয়েকেই কেন আম্মুর  মনে ধরলো তখন আমি বুঝতে পারলাম না।  আমার চোখেতো তখন  রঙিন চশমা। তবুও মায়ের উপর কথা বললাম না। এই পক্ষ ওই পক্ষ সবাই রাজি। কারণ পাএ হিসেবে আমি সোনার হরিণ। ঢাকার মতো শহরে নিজেদের বাড়ি, দেখতে শুনতে সুন্দর, ভালো চাকরি অমতের তো প্রশ্নই আসেনা। এ গর্বে গর্বিত আমির অহংকার ভেঙে চুরে  এক নিমিশে  ধুলিসাৎ করলো মিতু নামের এই সাধারণ মেয়েটি। ভেবেছিলাম গ্রামের মেয়ে।  মেকাপ,  শাড়ি, একগাধা গয়না পড়িয়ে হয়তো হাজির করবে।তাই দেখতে গিয়ে আমার আর আগ্রহ হলো না । ভাবলাম বাসায় ফিরে কিছু না কিছু বলে মানা করে দিলেই হবে। চুপচাপ মোবাইল ঘাটতে লাগলাম। আর যখন মায়ের খোঁচায় সামনে তাকালাম!  দেখলাম, সিম্পল থ্রি পিসে মাথায় হালকা ঘোমটা দিয়ে চোখ, মুখ শক্ত করে এক মেয়ে বসে আছে। এই চোখ, মুখ শক্ত করা সিম্পল মেয়েটার কাছেই আমি  প্রথম রিজেক্ট হলাম । কারণ! আমি ছিলাম তার চেয়ে নয় বছর, সাত মাস, এগারো দিনের বড়। আর তাল গাছের মতো লম্বা। তাঁর লম্বা ছেলে পছন্দ না। সারাজীবন নাকি হাই হিল পড়ে ঘুরতে হবে। সেটাও তাঁর পছন্দ না। আর সবচেয়ে বড় কথা। আমি নাকি বিয়ের পরেই ফেদরা শুরু করবো, এভাবে এটা করছো কেন? ওটা এবাবে রাখছো কেন?  এভাবে কথা বলছো কেন? খাচ্ছো কেন? বসছো কেন? হাটছো কেন? সে গ্রামের সাধারণ মেয়ে, সাধারণ কাওকেই বিয়ে করবে। 
কথায় আছে সত্য সবসময়ই তিক্ত। আর তিক্ত কোন মানুষেরি ভালো লাগে না। আমারও লাগলো না। সে আমার টাইপ ছিলো না। তবুও  তাঁর রিজেক্ট আমি সহজ ভাবে নিতে পারলাম না। কোথায় যেন একটু বেধেই থাকলো । সেই বাধাতেই মিতু নামের মেয়েটা আমার চোখের বিষ হয়ে গেলো । 

তাঁর কিছুদিন পরেই আমি বিয়ে করে ফেললাম। অফিসের এক কলিগের বোন। শহরের মেয়ে  সুন্দর,  লম্বা,  স্মার্ট। একেবারে পারফেক্ট ম্যাচ। কিন্তু শরীরের পারফেক্ট ম্যাচ হলেই কি আর মনের পারফেক্ট ম্যাচ হয়। সেটা বুঝতে পারলাম কিছুদিনের মধ্যেই। তাঁর খুশি ফেজবুক, টিকটিক মোবাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ আর আমার পূর্নিমা রাতে বারান্দায় হাতে হাত রেখে কফি খাওয়া। বৃষ্টির দিনে পুরো ফ্যামিলি মিলে খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা খাওয়া।  ছুটির বিকেলে রিকসার হুট ফেলে ঢাকার ব্যাস্ত রাস্তায় উড়া। আর সে! বড় বড় রেস্টুরেন্ট,আর  বিভিন্ন নামি দামি যায়গায় গিয়ে  ছবি অপলোড করা। যেখানে না থাকে কোন অনুভূতি, না থাকে ভালোবাসা। কোন মানুষই কেওর মনের মতো হয় না এটা ভেবে মেনে চলার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু সম্পর্ক কি আর এক দিক থেকে ধরে রাখা যায়। সে উড়তে চায় মুক্ত বিহঙ্গের মতো আর আমি চাই ক্লান্তি শেষে প্রাপ্তির সুখ। সেই সুখের ও সমাপ্তি হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল এক ভিডিও তে। যেখানে নিজের স্মার্ট, সুন্দর বউ একটু নামের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে আনায়াসে ।  যার বলি হলাম আমি, আমার পরিবার, আর আমার একমাএ সন্তান। যেই আয়নায় নিজেকে দেখে গর্ব করতাম, সেই আয়নায় ফিরেও তাকাইনা নিজেকে ঘৃনা হয়। যে চাকরির গর্ব করতাম, সেখানেও যেতে ভয় হয় হাসির পাএ হবো বলো। ঢাকা শহরে যে বাড়ির অহংকার করতাম, সেই বাড়িই এখন গলার কাটা, যদি ভাড়া থাকতাম এই এলাকা থেকে পালিয়ে বেঁচে যেতাম। দেখতে দেখতে সময়ের মতো সময় যেতে থাকলো। হাজারও ঘটনার তলে এই গল্পেরও সমাপ্তি হলো।  শুধু কাটার মতো বিধে থাকলো আমার, আর আমার  ছোট্ট ছেলের জীবনে। যা চাইলেই উগরে ফেলা যায়না। 

বাংলা অনুগল্প: তোমাকে নিয়ে লেখিকা নূপুর ইসলাম


আর এতো এতো কাহিনীর মধ্যে আমি ভুলেই গেলাম  ঐ যে ছোট মোট মিতু, যার দিকে আমি আগ্রহ নিয়ে তাকাইনি বলে এক গাদা অপমান করে রিজেক্ট করেছিলো। সে আবার আসলো, ভালোভাবেই আসলো।  অনেক দিন পরে ফুপির বাসায় আসলাম কাজিনেরর বিয়ে উপলক্ষে। এসেই অস্বস্তিতে পড়লাম। সবার মুখেই এক কথা। আমার কথা!  আফসোসের তলে  ক্ষতবিক্ষত করা। নিজের জন্য কষ্ট  না হলেও ছেলেটার জন্য হয়। তাঁর অসহায় মুখটার জন্য হয়। এই সব কথায় ছেলেটার উপর কি প্রভাব হয় এরা বুঝে না, বুঝতে চায়ও না। এতো এতো অস্বস্তির মধ্যে সোনালী সূর্যের মতো উদয়  হলো মিতু। আমার জন্য নয়, আহানের জন্য। ছোট বাচ্চা, মা নেই আসহায় বলে দয়া করে আদর যে করছে তা না। ধমকাচ্ছে,  খোঁচাচ্ছে, খেপাচ্ছে, এমনি কিছুক্ষণ আগে দেখলাম গালের মধ্যে ঠোকনাও মারছে। আমার দেখে কলিজা কেঁপে উঠলো। ওর মায়ের সাথে ডিভোর্সের পরে ওর গায়ে ফুলের টোকাও দেই না সেখানে। আমি রাগে তাঁকে বললাম, " এই মেয়ের সাথে কথা বলবে না। " আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বললো, - ফুপিতো খুব ভালো। তাঁর সাথে কথা বলবো না কেন? আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাঁকিয়ে রইলাম। তারপরে আদর মাখা কন্ঠে বললাম, " তুমি কি ভালো মন্দ বুঝো আব্বু? সে মাথা উপর নিচে  ঝুলাতে ঝুলাতে বললো, " আমি বুঝি। " আমি হেসে ফেললাম। বললাম, কিভাবে?  সে ফিসফিস করে বললো, কাল রাতে ফুপি আমাকে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলো, পার্কে! আমার মতো কতো বাচ্চা জানো আব্বু? তাঁদের মা নেই, বাবার নেই, ঘর নেই। আমারতো সবই আছে। তাহলে কেন অযথা মন খারাপ করে থাকবো।  ফুপি বলছে," এই পৃথিবী সবার সুখে থাকার অধিকার আছে। আর যার যার সুখ তাঁর তাঁর  নিজের খুঁজে নিতে হয়। তাই যে যা বলুক এক কান দিয়ে ঢোকাবে আরেক কান দিয়ে বের করবে।
যে এতো সুন্দর সুন্দর  কথা বলে সেতো পঁচা হয় না । তাছাড়া,  আমার ফুপির সাথে থাকতে ভালো লাগে আব্বু।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মেয়েদের প্রতি আজকাল আমার ঘৃনা কাজ করে। আর আজ অনের দিন পরে এই মেয়েটার প্রতি শ্রদ্ধা হলো। আর সাথে মনে অচেনা এক ভয়ও কাজ হলো, আহানের জন্য।
আহান দিনরাত মিতুর পিছু পিছু ঘুরছে। মিতু ধমকাচ্ছে, চোখ রাগাচ্ছে আবার কিছুক্ষণ পরে হেসে একগাদা চুমুতে চোখ, নাক ভরে ফেলছে। আর আমি শুধু আরচোখে তাঁদের দেখি। অবশ্য সোজাসুজি দেখলেও সমস্যা নেই। কারণ,  এই মেয়ে আমাকে গনায়ই ধরে না। আমি যে আশে পাশে আছি সে খেয়ালই করে না।
বিয়ের পরেরদিন একপ্রকার জোড় করেই তারাতারি বাসায় ফিরে আসলাম। কারণ!  আহান বা আমার হয়তো দুজনের জন্যই ভালো। আহান চুপচাপ, শান্তশিষ্ট ছেলে। কখনও কোন মর্জি নেই। সে যে মিতুকে মিস করছিলো শুধু আমি কেন  বাড়ির সবাই বুঝলো। মা তো আফসোস করে বলতেই লাগলো, " মেয়েটা আগেই রাজি হয়নি আর এখন, তবু যদি বিয়ে ঠিক হয়ে না থাকতো তবে এই নাতিটার জন্য হলেও হাতে পায়ে ধরতাম। 
আমি দীর্যশ্বাস ফেলে নিজেকে নিজেই বলি, " আমরা কতো সার্থপর।" 
এরপর হঠাৎ একদিন অচেনা এক নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ফোন ধরেই আমি থমকে গেলাম। এই প্রথম তাঁর সাথে আমার কথা বলা। আমি নিশ্বাস আটকে ফোন ধরে বসে রইলাম। আর সে নির্বিকার ভাবে বললো, " সিহাব ভাই, আমি মিতু! ঐ যে আপনার ফুপির ননদের মেয়ে। চিনেছেন?
--- আমি কোন রকমে হু বললাম।
--- সামনে সপ্তাহে আমার বিয়ে!  জানেন তো?
--- হুম।
--- আমি জানি আপনারা আসবেন না। এতো দূরের সম্পর্ক ধরে কেও আসেও না। তবুও কোন ভাবে কি আহানকে আসতে দিবেন। আসলে আমি চাইছিলাম সে আসুক। আবার কবে না কবে দেখা হয়। বিয়ের পরে বাহিরে চলে যাচ্ছি তো তাই।
এর পর আমার কি হলো কে জানে।   পুরো ফ্যামিলিকে ঠেলে ধাক্কিইয়ে  হাজির হলাম মিতুর বিয়েতে।

আহান আমার বুকে মুখ গুজে শুয়ে আছে। আমি জানি সে ঘুমাইনি। আমি তাঁর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, " ঘুমিয়ে পড় আব্বু। তুমি যা চাচ্ছো তা হয় না।  
চোখে তন্দ্রা লেখে এসেছিলো। ছুটে গেলো কলিং বেলের শব্দে।  ফুপিদের এলাকায়ই মিতুদের বাড়ি।   আমি আহানকে নিয়ে চলে এসেছিলাম। বাকি সবাই এখনো বিয়ে বাড়িতে । আমি এগিয়ে গেলাম। আর দরজা খুলে হতম্বভ হয়ে হয়ে গেলাম । 
মিতু আমার হতম্বভের ধারের কাছেও গেলো না। আমাকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে বললো, " সিহাব ভাই আমি পালিয়ে টালিয়ে বিয়ে করতে পারবো না। আপনি এক্ষুণি গিয়ে বাবা, মায়ের সাথে কথা বলবেন। তাঁরা অবশ্য সহজে রাজি হবে না। তবুও আহানের জন্য চেষ্টা করতে পারবেন না। 
আমি অবাক হয়ে সামনে হলুদ শাড়ি পড়া মেয়েটার দিকে তাকালাম। এমন নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে কি শুধু মেয়েরাই পারে। না!  মেয়েরা না মায়েরা পারে। আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে শুধু একজন মা। মা হওয়ার জন্য বিয়ে কিংবা সন্তান দশ মাস গর্ভে রাখার প্রয়োজন নেই। মা শুধুই মা। 
আমি দু-কদম তাঁর দিকে এগিয়ে  একটু ঝুকে বললাম, "শুধু চেষ্টা করবো না।  দরকার পড়লে পায়ে ধরে ভিক্ষা চাইবো। আমার ছেলের মায়ের বলে কথা। তাকে তো আমি ছাড়ছি না......

#সমাপ্ত
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post