** বাসর রাতে অহংকারী বউয়ের পতন **
লেখক --- মাহমুদ
পর্ব ১১ তথা শেষ
&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&
পেরিয়ে গেছে ২ টি মাস
এই দুই মাসে নীলা অনেকটাই বদলে গেছে। এখন আবিরের সব কথা মেনে চলে আবিরের কোন কিছুই বলতে হয় না নীলাকে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, বাসায় সব কাজকর্মও নিজে থেকেই করে। কিন্তু নীলার
মন বোঝা বড় কঠিন, আবির এখনো জানে না নীলা আদৌ ভাল হয়েছে, নাকি শুধু আবিরের ভায়ে এসব করছে।
দুমাস আগে সেদিনের পর আর কোন ফিজিক্যাল সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি ওদের মাঝে। ওরা সবসময় আলাদা বিছানায় আলাদাভাবেই থাকে। আবির ইচ্ছা করে আর কখনোই নীলার কাছে যায় নি। নীলাও আবিরকে কখনো কাছে ডাকে নি। দুজন একই বাড়িতে থেকেও যেন আলাদা দুটি মানুষ ওরা।
,
,
নীলা চুলার পারে বসে থেকে সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। আর আবির বারান্দায় বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। আবিরের হঠাৎ কি যেন হলো, আবির নীলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
আবিরঃ নীলা তুমি কি তোমার বাবার বাসায় যেতে চাও? যদি চাও তো বলো আজ বিকেলে তোমায় নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে ঘুরতে যাব। সেই যে বিয়ের পর চলে আসলাম আর তোমাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া হলো না। না জানি আমার শশুর মশাই কত রেগে আছেন তার জামাইয়ের উপর।
আবিরের কথা শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠল নীলা। তারপর দৌড়ে চুলার পার থেকে আবিরের সামনে এসে বলল
নীলাঃ তুমি সত্যি বলছো আবির? সত্যিই আমাকে নিয়ে যাবে বাবার কাছে? ইস কতদিন হলো বাবার বাসায় যাইনি প্লিজ দুষ্টামি করো না আমাকে নিয়ে চলো প্লিজ। আমি বাবার কাছে যেতে চাই আমাকে নিয়ে চলো আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে আবির। সে কবে থেকে একটানা এখানে পড়ে আছি। আর ভালো লাগেনা আমার। আমাকে নিয়ে চলো আমি দমবন্ধ হয়ে কখন মারা যাব হয়তো আর এখানে থাকলে।
নীলার কথা শুনে মুচকি হেসে আবির বলল
আবিরঃ আচ্ছা ঠিক আছে তুমি বিকেলবেলা রেডি হয়ে থেকো আমি তোমাকে নিয়ে যাব নীলা।
আবিরের কথা শুনে নাচতে নাচতে চলে গেল নীলা। ওর যেন খুশিতে আর সইছে না কোন কিছু। নীলা চলে গেলে আবির মনে মনে বলল
আবিরঃ আমি চাই না তোমাকে আর আটকে রাখতে। আমি দেখতে চাই আমি তুমি কি আদৌ ভালো হয়েছ নাকি এগুলো সবই তোমার নাটক আমার ভয়ে। আমি তোমাকে তোমার বাবার বাড়ি নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করতে চাই। তুমি যদি ভালো হয়ে থাকো তাহলে তো ভালো। আর যদি ভালো না হয়ে থাকো তাহলে আমি তোমার জীবন থেকে সারা জীবনের জন্য হারিয়ে যাব নীলা। আর কোনদিনও তোমার সামনে আসব না আমি। তুমি তোমার মত করে বাঁচো আমি আমার মত। তবে মনে রেখো সারাজীবন আমি শুধু তোমারই থাকবো নীলা। আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি খুব খুব ভালোবাসি তোমায় আমি নীলা। তা হয়তো আর বলা হবে না কখনো।মনে মনে
কথাগুলো ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আবির।
বিকেলে রেডিও হয়ে নীলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো আবির, উদ্দেশ্য নীলাদের বাড়ি। বাসা থেকে বেরোতেই যেন নিজেকে ডানা মেলা মুক্ত পাখি ভাবতে লাগলো নীলা। কোন দিকে কোন খেয়াল নেই নীলার। নীলা এখন একটা চিন্তায় আছে কখন নিজের বাসায় গিয়ে পৌঁছবে ও। এদিকে আবির মন খারাপ করে বসে আছে গাড়ির মধ্যে। আবিরের মনটা আজকে ভীষণ খারাপ, ওর মনে হচ্ছে যেন নিজের কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে কষ্টে। ও সব সময় একটা টেনশনে পড়ে যাচ্ছে, নীলা কি আদৌ ওর কাছে আবার ফিরে আসবে? নাকি এভাবেই সারা জীবনের মতো বিচ্ছেদ ঘটবে আজকে ওদের মাঝে। আবির এ কদিনে যেনো আরো বেশি ভালোবেসে ফেলেছি নীলাকে।
বেশ কিছুক্ষণ পর নীলার বাসার সামনে এসে ওদের সিএনজি থামল। থামার সাথে সাথে নীলা সিএনজি থেকে নেমে দৌড়ে বাসার মধ্যে ঢুকে গেল। আবির যে ওর সাথে আছে সেদিকে যেন ওর কোন খেয়াল নেই। নীলা চলে গেলে আবির সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে ধীরে ধীরে পা বাড়ালো নীলার বাড়ির দিকে।আবির নীলার বাসার গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই বাধা হয়ে দাড়ালো নীলা। তারপর বলতে লাগলো
নীলাঃ কোথায় যাচ্ছিস তুই আবির?আমার বাসায় প্রবেশ করার সাহস হয় কি করে তোর?
নীলার কথা শুনে অবাক চোখে নীলার দিকে তাকাল আবির। নিলা সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে আবার বলতে শুরু করল
নীলাঃ কি ভেবেছিলি তুই এতো সহজেই আমি তাকে মেনে নেব, কখনোই না আবির। এই তিনটা মাস ধরে আমাকে যে পরিমান কষ্ট দিয়েছিস ঠিক একই পরিমান কষ্ট দিয়ে তিলে তিলে শেষ করব আমি তোকে। আমি জীবনে নিজের হাত নিজে পানি ঢেলে ধুয়ে কখনও ভাত খাইনি। আর সেই আমাকে দিয়ে তুই রান্না করিয়েছিস, কাপড় কাচিয়েয়েছিস, বাসার সব কাজ করিয়েছিস তুই আমায় দিয়ে। এই সবকিছুর হিসাব নেব আমি তোর থেকে আবির। তুই রেডি থাক তোর জীবন আমি শেষ করতে নেমে পড়বো এখন। তোর সাহস কি করে হয় আমার সাথে এমন ব্যবহার করার। এতদিন তোর হাতের মার খাবার ভয়ে আমি কিছু বলিনি। কিন্তু এখন আমি মুক্ত আমাকে আর কিছু বলার মত আর কোন উপায় নেই তোর। তাই ভালো চাষ এখান থেকে চলে যা। আর যদি চলে না যাস তাহলে তুই ভাবতেও পারবি না তোর কত বড় ক্ষতি করে দিবো আমি। আমি তোকে খুন করে ফেলবো আবির।
নীলার কথা শুনে যেন একটুও অবাক হল না আবির। নীলার দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নীলার কাছে এগিয়ে গিয়ে নীলার দুগালে হাত রেখে কপালে একটা চুমু একে দিয়ে আস্তে করে বললো
আবিরঃ ভালো থেকো নীলা,,,,,
কথাটা বলেই আবির উল্টো পথে হাঁটা দিলো। তারপর সোজা গেইট দিয়ে বেরিয়ে কোন দিকে যেন চলে গেলো আবির। নীলা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল থ মেরে। যেন কোন কিছুই ঢুকছে এখন নীলার মাথায়।তবে মনে মনে খুশিও হল আবির ওকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছে ভেবে।
তারপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে নীলা বাসার মধ্যে ঢুকে গেল। বাসার ভিতরে ঢুকতেই নীলা দেখতে পেল ওর ড্যাডি কি যেন দেখছে খুব মনযোগ দিয়ে সোফায় বসে। নীলা ড্যাডি বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ওর ড্যাডিকে জড়িয়ে ধরল। তারপর চিৎকার করে কান্না করে বললো
নীলাঃ কেমন আছো তুমি ড্যাডি?আমার কথা কি ভুলে গেছো তুমি? একবারও আমার কথা মনে পরে নি তোমার?
নীলার কথা শুনে নীলাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে তাঁকিয়ে নীলার ড্যাডি বললো
নীলার বাবাঃ কি ব্যপার নিলা তুমি একা এসেছো আবির কোথায় ওকে দেখছি না যে?
ড্যাডির কথা শুনে অবাক হলো নীলা, তারপরে ড্যাডির দিকে অবাক চোখে তাঁকিয়ে নীলা বললো
নীলাঃ ড্যাডি আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি অথচ তুমি আমাকে ছেড়ে ঐ আবিরের কথা বলছো? আমি যে কাঁদছি ওেএদিকে তোমার কোন খেয়াল নেই, তুমি এতটাই পর করে দিয়েছো আমায় ড্যাডি? বিয়ে হয়েছে বলে কি আমি তোমার আর কিছু হইনা পর হয়ে গেছি আমি?
নীলার ড্যাডিঃ
আমি কি তোমায় সেটা বলেছি নীলা, আমি বলছি আবির কোথায়? তোমাদের দুজনের তো একসাথে আসার কথা ছিল। তাহলে তুমি একা এলে যে আবির এলোনা কেন? আবিরকে দেখতে পাচ্ছিনা ও কোথায় নীলা?
নীলাঃ আবির আবির আবির কি বলছো তুমি ড্যাডি? আমি আসার পর থেকে তুমি আমাকে ফেলে তখন থেকেই আবির আবির করে যাচ্ছ। আমি কি তোমার এতোটাই পর হয়ে গেছি যে তুমি আমাকে এতটা দূরে ঠেলে দিচ্ছো ড্যাডি? তুমি জানো ঐ আবির নামের শয়তান ছেলেটা আমার সাথে কি কি করেছে, ও তোমার সাথে মিথ্যা বলে আমাকে বিয়ে করেছে ও একটা ফকিরের ঘরের ছেলে ওর বাবা একজন রিক্সা চালক ছিলো।ও কোন বড়লোক নয় অথচ তোমার কাছে বড়লোক সেজে আমায় বিয়ে করেছে ও। ওই আবির একটা ঠকবাজ শয়তান ছেলে ড্যাডি। ও আমায় ঠকিয়ে বিয়ে করেছে তারপর আমাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চাকরের মতো খাটিয়েছে এই তিনটা মাস। জানো ড্যাডি আমাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করিয়েছে ঐ আবির।ওকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো খুন করে ফেলবো ওকে আমি।
কথাগুলো বলার সাথে সাথে নীলার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পর মেরে দিল ওর ড্যাডি। থাপ্পড় খেয়ে নিচে ফ্লোরে পড়ে গেল নীলা।তারপর গালে হাত দিয়ে ওর ড্যাডির দিকে অবাক চোখে তাঁকিয়ে বললো
নীলাঃ তুমি আমাকে মারলে ড্যাডি?
নীলার ড্যাডিঃ হ্যাঁ আমি তোমায় মারলাম নীলা। কারণ এই মারটা আমার অনেক আগেই তোমাকে মারা উচিত ছিল। কিন্তু আমি যেটা করতে পারিনি সেটা তোমায় আবির করে দেখিয়েছে। তুমি যে কতটা নিচে নেমে গেছো তুমি সেটা নিজেও জানো না নীলা। তোমাকে ঠিক করার জন্য আবিরই যথেষ্ট।
নীলাঃ তুমি এসব কি বলছ ড্যাডি? তুমি কি ভাবে আবিরের হয়ে কথা বলছো এত কিছু জানার পরেও। যে তোমার মেয়েকে অনেক জ্বালিয়েছে কষ্ট দিয়েছে তার পরেও তুমি সেই আবিরের জন্য এভাবে আমাকে মারলে? কেন ড্যাডি কেন আমার চাইতে ঐ আবিরই কি তোমার কাছে বেশি বড় হয়ে গেল? আমি কি তোমার কিছুই নয় ড্যাডি?
নীলার কথা শুনে ওর ড্যাডি অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো
নীলার ড্যাডিঃ হ্যাঁ তুমি ঠিক ধরেছ নীলা তোমার চাইতেও ঐ আবির আমার কাছে অনেক বড়। কেন জানো ওই আবিরের আজকে এত গরীব হওয়ার জন্য শুধুমাত্র আমি দায়ী। আর ওর বাবার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী নীলা। ঠিক তেমনি আবিরের এত কষ্টের কারণ তুমি আমি আমরা দুজনেই।
ড্যাডির কথা শুনে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো নীলা। তারপর অবাক হয়ে ওর ড্যাডির দিকে তাকিয়ে বললো
নীলাঃ এসব তুমি কি বলছ আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা ড্যাডি?কিসেব কথা বলছো তুমি ড্যাডি? আবিরের গরীব হওয়ার জন্য তুমি কেন দায়ী হতে যাবে? মানলাম ওর বাবার মৃত্যুর জন্য হয়তো ভুল করে হলেও আমি দায়ী। কিন্তু তুমি কেন ওর গরীব হওয়ার পেছনের কারণ হতে যাবে?
নীলার কথা শুনে টেবিলের উপরে রাখা ছবির ফ্রেম গুলো নিয়ে নীলার সামনে ধরল নীলার ড্যাডি। তারপর বলল
নীলার ড্যাডিঃ এই দেখো নিলা এখানের ছবিগুলো কে চিনতে পারছো? বলতো এরা কারা দেখি বলতে পারো কিনা এখানে কে কে আছে।
ড্যাডির হাত থেকে ছবিগুলো নিয়ে নীলা বললো
নীলাঃ এখানে তো এটা তুমি আর এটা আম্মু কিন্তু পাশের লোকটা কে ড্যাডি? মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি আমি লোকটাকে, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিনা কোথায় দেখেছি।
নীলার ড্যাডিঃ পাশের ঐ লোকটা তোমার মামা আর আবিরের আব্বু নীলা। মানে তোমার শ্বশুর মশাই, যার মৃত্যুর কারন তুমি নিজে।
ড্যাডির কথা শুনে অবাক হয়ে নীলা বললো
নীলাঃ এ তুমি কি বলছ ড্যাডি এটা আমার মামা আর আবিরের আব্বু হয় কি করে? আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না ড্যাডি?
নীলার ড্যাডিঃ হ্যাঁ নিলা এটাই সত্যি ওটা তোমার মামা আর আবিরের আব্বু, আবির তোমার আপন মামাতো ভাই।
নীলাঃ কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ড্যাডি? আমি তো কখনো মামার ব্যাপারে তোমাদের কাছে কিছু শুনিনি? তবে হ্যাঁ ছোটবেলা আম্মুকে কান্না করতে দেখতাম মামার জন্য, কিন্তু কখনোই কিছু বুঝতাম না। তোমাকেও দেখতাম আম্মুকে বোঝাতে নানা রকম কথা বলে। কিন্তু কখনো তো বলোনি যে আমার মামা একজন রিক্সা চালক?
নীলার ড্যাডিঃ তোমার মামা কোন রিক্সা চালক নয় নীলা। বরং সে ছিল ঢাকার সবচাইতে বড় বিজনেসম্যান এর একমাত্র বড় ছেলে। কিন্তু একমাত্র তোমার আম্মু আর আমার জন্য তাকে একজন রিক্সা চালকে পরিনত হতে হয়েছিলো। আত্মীয়-স্বজন বাড়ি-গাড়ি-সবকিছু ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয়েছিল ওই ছোট্ট গ্রামের কুঁড়েঘরে। যেখানে থেকে সারাদিন রিক্সা চালিয়ে নিজের পরিবার চালাতে হতো তাকে।
নীলাঃ কিন্তু তোমাদের মাঝে এমন কি হয়েছিল ড্যাডি যার কারণে মামাকে গ্রামে ওখানে চলে গিয়ে রিক্সা চালাতে হলো? সে শহরে ফিরে কেন আসেনি এত বাড়ি গাড়ি থাকতে সে কেন চলে গেল গ্রামে। কি এমন হয়েছিল যার জন্য তোমরা নিজেদের দায়ী করছো? আমি জানতে চাই ড্যাডি সবকিছু জানতে চাই আমি।
নীলার কথা শুনে নীলার ড্যাডি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলো
নীলার ড্যাডিঃ তাহলে শোনো নীলা আজ থেকে 20 বছর আগের কথা। তোমার মামা আর আমি ছিলাম সবচাইতে কাছের দুজন বন্ধু। কলেজে একসাথে পড়াশোনা করতাম আমরা। পুরো কলেজের মাঝে আমরা ছিলাম সবচাইতে ভালো বেস্ট ফ্রেন্ড। তোমার আম্মুও একি কলেজে পড়তো আমাদের সাথে।তোমার আম্মুকে আমার প্রথম দেখা থেকেই ভালো লাগতো। কিন্তু কখনো বলে উঠতে পারেনি কারণ আমি ছিলাম একজন গরিব গরিব কৃষকের ছেলে। আর তোমার আম্মু ছিল ঢাকার সবচেয়ে বড় বিজনেসম্যান এর একমাত্র মেয়ে। যে কারণে ভয় পেয়ে কখনো তোমার আম্মুকে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু তোমার আম্মুও মনে মনে ভালবাসত আমাকে এটা একসময় তোমার মামা জানতে পারে। তোমার মামা এতটাই ভাল ছিল যে কখনও ধনী বলে গরিবদের অবহেলা করত না। বরং ও গরিবদের খুব ভালোবাসতো। তাই আমাদের ভালোবাসার কথাটা জানতে পেরে তোমার মামা সিদ্ধান্ত নেয় তোমার আম্মুর সাথে আমাকে বিয়ে দিবে। কিন্তু এখানে বাধ সাধে তোমার নানা। সে আমার আর তোমার আম্মুর সম্পর্কের কথা জানতে পেরে ডাইরেক্ট বলে দেয়, কোন কৃষকের ছেলের সাথে সে তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিবে না। তবুও যদি তার মেয়ে আমায় বিয়ে করতে চায় তাহলে সে তার মেয়েকে ত্যাজ্য করবে। তখন তোমার মামা আমাদের ভালোর জন্য নিজের সমস্ত সম্পত্তি তোমার আম্মুর নামে হস্তান্তর করে দেয়। যেটা আমরা কেউই জানতাম না। কিন্তু যখন তোমার নানা এসব ব্যাপারে জানতে পারে তখন তোমার মামাকে ত্যাজ্যপুত্র করে। আর বলে যে তোমার মামা যদি আর এই শহরে থাকে তাহলে তোমার মামা তোমার নানার মরা মুখ দেখবে। সে জন্য সেদিনই তোমার মামা এই শহর ছেড়ে আমাদের কাউকে না জানিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আমরা তারপর অনেক খুজেছি তাকে তোমার নানাও নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমাদের বিয়ে দেয় আর তোমার মামাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে।কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো আমরা কোথাও তাকে খুঁজে পাইনা। আর এত বছর পর যখন তাকে খুঁজে পাই তখন সে মারা গেছে। আর সেটাও তোমার কারনে নীলা শুধু মাত্র তোমার কারনে।
এতোটুকু বলে থামল নীলার ড্যাডি। ড্যাডির কথা শুনে অবাক হয়ে নীলা বললো
নীলাঃ এত কিছু ঘটে গেছে অথচ আমি কোন কিছুই জানিনা এসব কথা। তুমি আমায় আগে কেন বলনি যে আমি মামার মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমার জন্য আমার মামার এভাবে মৃত্যু হবে আমি কখনো ভাবতে পারিনি ড্যাডি।যে মামা তোমাদের জন্য এতকিছু করেছে সেই মামার মৃত্যুর কারন হব আমি! ভাবতেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে ড্যাডি। আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা এটা।
নীলার কথা শুনে ও ড্যাডি বলল
নীলার ড্যাডিঃ জানো নীলা যখন আমি জানতে পারলাম যে তুমি একটা ছেলেকে জেলে পাঠিয়েছো। তখন আমি এক মিনিটও দেরি না করে সেখানে চলে গিয়েছিলাম, কারণ আমি আগে থেকেই জানতাম তোমার রাগ সম্পর্কে। আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম নিশ্চয়ই ছেলেটার কোন দোষ নেই আর তুমি নিশ্চয়ই নিজের রাগের বসে ওকে বিনা দোষে জেলে পাঠিয়েছ। তাই আমি ছেলেটার কাছে যাই ওকে ছাড়াবো বলে, কিন্তু কখনো ভাবতে পারিনি এই ছেলেটাই হবে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর ছেলে। যখন ওর সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারি তখন বুঝতে পারি যে ও তোমার মামার ছেলে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল তোমার মামাকে আমি শেষ দেখাটা দেখতে পারিনি। সে ছেলের জেলে যাওয়ার কথা শুনে হার্ট এটাক করে মারা গিয়েছিলেন। সেই মুহুর্তে তোমার উপর খুব রাগ হয়েছিল আমার নীলা। আমার ইচ্ছে করছিল বাসায় এসে তোমাকে ত্যাজ্য করে দিতে, কিন্তু আমাকে থামিয়ে দিয়ে সেদিন আবির কি বলেছিল জানো? ও বলেছিল আমি যেন তোমাকে কিছুই না করি কারণ ও তোমাকে ভালবাসে। আর তোমাকেই বিয়ে করতে চায়। আমার কাছে দাবি করেছিল তোমাকে চেয়েছিল তোমাকে বিয়ে করে ভালো করতে। তাই আমি ওর সাথে তোমার বিয়েটা দেই কিন্তু তোমাকে না জানিয়ে। আমার এই সমস্ত সম্পত্তির মালিক শুধুমাত্র আবির। কারণ আবিরের বাবা মানে তোমার মামা যদি সেদিন নিজের সব সম্পত্তি আমাদের না দিতো তাহলে আজকে আবিরের জায়গায় তুমি থাকতে নীলা। আর ওর রিক্স চালক বাবার জায়গায় থাকতাম আমি। শুধু মাত্র তোমার মামার সেই আত্বত্যাগের জন্যেই আজ আমরা এতো সুখে আছি।
নীলাঃ কিন্তু ড্যাডি মামা তো অনেক পড়াশুনা জানত, কলেজেও পড়েছে। তাহলে মামা ভালো কোন চাকরি না করে রিক্সা চালক কেন হলো। সে তো ভালো কোন চাকরি করতে পারতো। কিন্তু গ্রামে কেনো রিক্সা চালিয়ে সেখানে থাকতে গেল?
নীলার ড্যাডিঃ কারণ তোমার মামা চায়নি তোমার নানার সামনে এসে তোমার নানার মরা মুখ দেখতে। তোমার নানা যখন তোমার মামাকে ওই কসম দিয়েছিল যে তোমার মামা যদি এই শহরে আসে তাহলে তোমার নানার মরা মুখ দেখবে। সেদিনই তোমার মামা এখান থেকে চলে যায় আর কখনো শহরে আসেনি, এমনকি ছেলের পড়াশোনার জন্য ছেলের কাছে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে, তারপরও নিজে শহরে আসেনি। শুধুমাত্র বাবার কথা রাখার জন্য এতটাই ভাল একজন মানুষ ছিল তোমার মামা। কিন্তু একমাত্র তোমার কারনে লোকটা হার্ট এটাক করে মারা গেছে নীলা শুধুমাত্র তোমার কারণে। তোমাকে মেয়ে বলে পরিচয় দিতে আমার আজ ঘৃনা হচ্ছে নীলা। তুমি আমার মেয়ে হয়ে আমার সম্মান সবকিছু মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছো। শুধু আমার বন্ধুকেই তুমি মেরে ফেলনি তার সাথে মেরে ফেলেছো আমার সম্মান আমার বন্ধুত্ব। তোমার মামার মতো আবিরও আজকে হয়তো তোমার জন্য দূরে চলে গেলো সারাজীবনের জন্য। আবির আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল তোমাকে ও ভালো করে ফেলেছে। কিন্তু তুমি যদি ভাল না হয়ে থাকো তোমার যদি এসব কিছু সাজানো নাটক হয়ে থাকে তাহলে আবির সারা জীবনের জন্য হারিয়ে যাবে নীলা।
ড্যাডির কথা শুনে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো নীলা। তারপর কান্না করে দিয়ে বলল
নীলাঃ এ হতে পারেনা ড্যাডি, এটা কিছুতেই হতে পারে না। আমি আবিরকে কোথাও যেতে দিব না। আমি ভুল করেছি ওর কাছে ক্ষমা চাইবো আমি। ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবো আমি ড্যাডি।আবিরকে ছাড়া বাঁচতে পারব না আমি ড্যাডি ওকে তুমি এনে দাও ড্যাডি আমার ওকে চাই ড্যাডি আমার ওকে চাই।
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এল নীলার। নীলা অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। নীলাকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে দেখে, ওর কাছে ওর ড্যাডি দৌড়ে গিয়ে নীলাকে ধরে ফেলল। তারপর ডাকতে লাগলো
নীলার ড্যাডিঃ নীলা নীলা, এই নীলা কথা বল মা আমার সাথে। কি হলো তোর নীলা?
নীলাকে পাগলের মত ডাকতে লাগল ওর ড্যাডি। কিন্তু নীলার কিছুতেই জ্ঞান ফিরছে না। পড়ে কোন উপায় না পেয়ে নীলাকে কোলে তুলে নিল। তারপর গাড়িতে নিয়ে বসে ড্রাইভারকে নিয়ে সোজা চলে গেল হাসপাতালে। হাসপাতালে পৌঁছে আবিরকে ফোন দিল নীলার ড্যাডি।
ওদিকে আবির ফোনের মাঝে নীলার ঘুমন্ত ছবিগুলো দেখছিলো। নীলা যখন রাতে ঘুমিয়ে থাকতো তখন আবির চুপিচুপি নীলার বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছিল। কারণ আবির নীলাকে অনেক ভালোবাসতো। সে ছবিগুলো দেখছে আবির আর চোখের জল ফেলছে।কারণ এখনই ও ফোনটা চিরদিনের মতো বন্ধ করে দিয়ে এই দেশ ছেড়ে চিরদিনের মত অন্য দেশে পাড়ি দেবে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল আবিরের। ফোনের স্কিনে নীলার ড্যাডির নাম্বার দেখে ফোন ধবে কি ধরবে না চিন্তা করতে করতে ফোনটা রিসিভ করেই ফেললো আবির। সাথে সাথে ফোনের ওপাশ থেকে নীলার ড্যাডি বলল
নীলার ড্যাডিঃ
আবির বাবা তুমি কোথায় আছো জলদি হাসপাতালে চলে আসো। আমার নীলার অবস্থা খুব খারাপ ও তোমার ব্যাপারে সবকিছু জানতে পেরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি ডাক্তার দেখছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো নীলা তোমার জন্য পাগলামি করছে।
নীলার ড্যাডির কথা শুনে এক মুহূর্ত দেরি না করে আবির ছুটল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। খুব দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে গেলো আবির।তারপর দৌড়ে চলে গেল নীলার কেবিনের সামনে। আবির পৌঁছাতেই নীলার কেবিন থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসলো। তারপর নিলার ড্যাডিকে উদ্দেশ্য করে হাসি মুখে বলল
ডাক্তারঃ কংগ্রাচুলেশন মিষ্টার খান। একটা সুখবর আছে, আপনার মেয়ে মা হতে চলেছে আর আপনি নানা ভাই হতে চলেছেন। তাড়াতাড়ি মিষ্টি খাওয়ান মিষ্টার খান।
ডাক্তারের কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো আবির। যেন মুহুর্তের মাঝে ওর সবকিছু থেমে গেল সেখানেই। আবির হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। এদিকে নীলার ড্যাডিরও একি অবস্থা। খুশিতে
কথা বলতে ভুলে গেছে সে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নীলার ড্যাডি ডাক্তার কে উদ্দেশ্য করে বলল
নীলার ড্যাডিঃ নীলাকে কি এখন দেখা যাবে, ওর কাছে কি এখন যাওয়া যাবে ডাক্তার। নীলার ড্যাডির কথা শুনে ডাক্তার মুচকি হেসে বলল
ডাক্তারঃ হ্যাঁ অবশ্যই যেতে পারবেন তবে নীলা জ্ঞান ফেরার পর শুধু ওর স্বামীকে খুঁজছে। ওর স্বামী গেলে ভালো হয়।
আবির ডাক্তারের কথাটা শোনামাত্র কাউকে কোন কিছু না বলে সোজা নীলার কেবিনে ঢুঁকে পড়লো। নীলা নিজের বেডে বসে অন্য দিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে।আবির সোজা গিয়ে নীলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আচমকা এভাবে জরিয়ে ধরায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নীলা আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো
নীলাঃ আবির কি করছো কি আমার বাবু ব্যথা পাবে তো। আবির নীলার কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। তাই নীলাকে ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ালো আবির। সরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে নীলা আবিরের হাত টেনে আবার জড়িয়ে ধরে বলল
নীলাঃ এই তুমি আমায় ছেড়ে দূরে যাচ্ছ কেন? আমি কি তোমাকে দূরে যেতে বলেছি? আমাকে ছেড়ে যাওয়ার খুব শখ তাই না। আর একবার ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে দেখো ঠ্যাং ভেঙে বাড়িতে ফেলে রাখবো তোমায় আমি।এতদিন তুমি আমায় মেরেছো এখন থেকে আমি তোমায় মারব এখন থেকে উল্টা শাসন হবে বুঝলে? আর আমাকে কিছু বলতে আসলে আমার ছেলে তোমায় শাসন করবে হুমম।
নীলার কথা শুনে মিষ্টি হেসে নীলাকে জড়িয়ে নিল আবির। তারপরে দুজনেই হা হা করে হাসতে লাগলো। আজ যেন ভালোবাসা পূর্ণতা পেল ওদের মাঝে। সব অবহেলা মিথ্যে অভিনয় সবকিছু ভুলে আজ দুজন এক হয়ে গেল এ যেন ভালোবাসার এক সীমান্তহীন সাগর।
এভাবেই বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সকলের ভালোবাসা এই দোয়াই করি। আজকের গল্পটা এখানেই শেষ। আগামী গল্পের জন্য সবাই অপেক্ষা করুন। আল্লাহ হাফেজ সবাই ওদের ভালোবাসার জন্য দোয়া করবেন। আর ভালো থাকবেন।
❤❤❤❤❤❤সমাপ্ত❤❤❤❤❤❤
পুরো গল্পটা পড়ে সকলের কেমন লেগেছে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন সবাই।গল্পটা এক্টু দ্রুতো শেষ করতে হলো। ইদানীং খুব বিজি তাই দুটি গল্প লেখা কষ্টকর হয়ে গেছে। ধন্যবাদ সবাইকে💚💚
গল্প সম্পর্কে আলোচনা করতে আমার গ্রুপ **স্বপ্ন চারিণী ভালোবাসার গল্প ** গ্রুপে এড হয়ে নিন সবাই।